শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:২১ অপরাহ্ন
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক, একুশের কন্ঠ : মানুষ ভালোবেসে ফেলেছে টাকাকে! পূজা করতে শিখেছে ক্ষমতাকে! বিশ্বাস করতে শিখেছে মিথ্যা আশ্বাসকে! সম্মান করতে শিখেছে অধিকার হরণকারীকে! ভরসা করছে বিশ্বাস ভঙ্গকারীকে। মানুষ আসলে মানসিকতায় বদলে গেছে! নৈতিক তা যতটা কথায় তার ছিটেফোঁটাও বিশ্বাসে নাই। কাজে নাই তার সিকি ভাগও! এই যে বইয়ের পাতায় পাতায় শুদ্ধাচার, বক্তৃতা-সেমিনারে নৈতিকতার কথা তা যারা বলছে তারাও ধারণ করছে না। যারা শুনছে তারাও মানছে না। ধর্মকে বানিয়েছে আত্মরক্ষার হাতিয়ার। ধর্মের কেবল সেটুকু মানে যেটুকুতে মানুষের স্বার্থ রক্ষা পায়। অন্যকে দমাতে সুবিধে হয়। সম্পর্কে সেটুকু বেঁচে আছে যেখানে যেখানে নিজের ভাগ বাঁচে। মানুষ কথায় কথায় বেচে দেয় আত্মসম্মান বোধ। নষ্ট করে বিশ্বাস। ধ্বংস করে শুদ্ধতা ও পবিত্রতা।
গ্রামে গিয়ে মুরুব্বীকে শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার সরকারি চাকুরিজীবী সন্তানের এখন পোস্টিং কোথায়! এই এক প্রশ্নের উত্তরে শুনতে হলো, তার ছেলে বরিশালে তিনতলা বাড়ি করেছে, ঢাকায় কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে, আরও কিছু খালি জায়গা কিনেছে! কী চাকুরি করে সেটা আমি জানি! কিন্তু চাচায় জানে কি-না জানি না, সরকারি চাকুরিতে যা বেতন এবং সুযোগ সুবিধা তাতে অবসরের পরে যে টাকা পাওয়া যায় তাতে মাত্র ছোট্ট একটা নীড় হতে পারে! সবার যে হয় তাও না! চাচা হয়তো জানে তার সন্তানের আয়ের উৎস! তিনি সেটা নিয়ে গর্ববোধও করেন! এই যে গতবার তিনি হজ্জ্বও করে এসেছেন। মসজিদের সভাপতি, মাহফিল-মাদরাসার দাতা! তার ছেলের বেতনের বাইরে বাড়তি অনেক আয়-সেটা গর্বের বিষয় বটে! তবে আশার কথা, এখনো সৎ মানুষের অভাব নাই। সেজন্যই আমরা টিকে আছি।
গ্রামের সেই বড় ভাইটিকে চিনতাম যে ছোট্ট বেলায় আমাদের নীতিকথা শোনাতেন। আমরা তাকে আদর্শ মানতাম! বড় হয়ে তার মত হতে চাইতাম! অথচ ছোট চাকুরি পাওয়ার পরেও তিনি বড় অঙ্কের টাকা ও সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন! এখন ব্যক্তিগতভাবে তাকে আদর্শ মানি না। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তার মত হতে চায়। যাদের অনেক টাকা থাকবে। গাড়ি-বাড়ির বিলাসিতা হবে! এটা দোষের নয় কিন্তু পথটা তো গুণের নয়! তারা অল্প বয়সেই, শর্টকার্ট শ্রমেই অনেক কিছু করতে চায়! প্রজন্মের মধ্যে যে ভ্রষ্ট মূল্যবোধ জন্মেছে তাতে আর অবাক হই না। সবার লক্ষ্যই এখন টাকা, ক্ষমতা! পাওয়ার, পাওয়ার শুনলে সবাই বেঁহুশ হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় মেরুদন্ডসহ মস্তক নত করে!
ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে নৈতিকতার যে অধঃপতন ঘটেছে তাতে মানুষ এখন ক্ষমতাহীন, অর্থহীন সম্মান চায় না। না নিজের মধ্যে না অন্যের মধ্যে! টাকাই সব! প্রতিবাদের ভাষা ও ক্ষমতা নখদন্তহীন! ভোগবাদীরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, টাকাই তোমার দ্বিতীয় প্রভূ! ক্ষমতা এক নম্বরের! যিনি আসল প্রভূ তিনি এসব শুনে হয়তো বিস্ময়ে হাসেন! দুঃখ করেন কিনা জানি না। গ্রাম থেকে নগর, নগর থেকে শহর, সর্বত্রই ক্ষমতার প্রেম ও মোহে সবাই! সবার ক্ষমতা চাই! গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট কোমলমতি ছেলে, যাদের বইখাতা নিয়ে ক্লাসরুমে থাকার কথা তারাও কোন ক্ষমতাধর ভাই নামক খুঁটির ছায়ায়! সবকিছুর ভালো-মন্দ বিচার করি টাকার মানদন্ডে! তবে আশার কথা, আমাদের মেয়েরা লেখাপড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগুচ্ছে। ছেলেদের নিয়ে মন্তব্যহীন রইলাম!
ফুটবল-ক্রিকেটকে ঘিরে ভার্চুয়াল জুয়ার আসর বসেছে! একদল জিতেছে তো আরেকদল সর্বস্ব হারাচ্ছে! গ্রামে গ্রামে পারিবারিক অস্থিরতা ও অশান্তি বাড়ছে। বখে যাওয়া কিশোর গ্যাং সামলানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার ও প্রশাসন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। ঐ যে, সর্ষের মধ্যেও ভূতের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। খেলার মাঠে কেউ নাই! বিরাণ! শূন্যতায় খা খা করছে তারুণ্যের ভালোবাসার জমিন!
এসবের খেসারত কী দিতে হবে না? অবশ্যই হবে। প্রজন্মের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ভয়াবহভাবে হৃাস পেয়েছে। দেশপ্রেম কমছে। আদর্শনিষ্ঠ মূল্যবোধ ভূ-তলে ধাবমান। নীতি এবং দুর্নীতির যে ভেদ রেখা তা হারিয়ে ফেলেছে। অন্যায়-অবৈধতা হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে এবং নিজেরাও জড়াচ্ছে। কোন ধরণের সৃষ্টিশীলতা নাই। পড়াশুনার প্রতি ঔদাসীন্য বাড়ছে। দু’একটা গল্প-কবিতার বই পড়ে এমন তরুণ-তরুণী দিনে দিনে বিরলের কোঠায় ঠেকছে! সবাই যখন ক্ষমতার পিছনে দৌড়ায়, যেকোন ভাবে টাকা আয় করতে চায়, অন্যকে দমন করে সুখ পায় তখন বুঝতে হবে আমাদের পথচলা সঠিক পথে নাই।
এই যে অন্ধ হয়ে টাকার পিছনে ছোটা, ক্ষমতার পদলেহন করা, জানাশোনার পথ ভোলা সেটা থেকে বের হতেই হবে। জীবন শুধু টাকা দিয়ে চলে না। ক্ষমতার বাইরেও যে জীবন সে জীবন অসুন্দর নয় বরং বেশিই সুন্দর। সবার সাথে মিলে থাকার মধ্যে স্বস্তি আছে। অহেতুক অহংকার জীবনকে বিষিয়ে তোলে। হামভরা মনোভাব, সম্পদ ও ক্ষমতার বড়াই মানুষকে ডোবায়। আমাদের বোধোদয় ঘটুক। একটি বদলে যাওয়া নতুন ভোরের অপেক্ষায় আসমুদ্র-হিমাচলের পথে সফর দীর্ঘায়িত হোক। মৃত্যুর পরেও জীবিত থাকার কিছু কীর্তি, মানুষের মনে রাখা কিছু দৃষ্টান্ত মানুষের থাকুক। অতীতের ছাপেই ভবিষ্যত পথ দেখে। বর্তমান তার স্বাক্ষী দেয়!